The Heart Travels

লক ডাউনের এই সময় আর নতুন কিছু লেখার নেই। তাই পুরানো স্মৃতি ফিরিয়ে  নিয়ে আশা ছাড়া আর উপায় নেই।  শীতের ছুটি  ১৯৮৯ এর কথা মনে আসে।  খাওয়ার টেবিলে আলোচনা হচ্ছিলো কোথাও যাওয়া হবে।  মা প্রস্তাব দিলো শিমলা যাওয়ার। হ্যা শীতকালে বরফের দেশে যাওয়ার কথা যা বাঙালিরা ভাবতেই পারে না।  যাবো আমরা পাঁচ জন – বাবা, মা, দাদু , দিদার সাথে আমি।
বরফের থেকেও আমার কাছে বেশি উত্তেজনার কারণ  হলো দুই রাতের ট্রেন ভ্রমণ। কালকা  মেলের এ সি ২  টায়ার এ বুকিং হয়ে গেলো আর ছুটি শুরু হওয়ার এক দিন পরেই রওনা দেওয়া।

সন্ধ্যা সাতটায় ট্রেন ছাড়ার কথা।  যথা সময় হাওড়া স্টেশন পৌঁছলাম এবং জানতে পারলাম ট্রেন পাঁচ ঘন্টা লেট্।  এখনো ডাউন ট্রেন  এসেই পৌঁছয়নি।  কি আর করা যাবে।  ঠিক হলো ওয়েটিং রুমেই  কাটানো হবে এই পাঁচ ঘন্টা , বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার আসার কোনো মানে হয় না। এই রকম অবস্থায় সময় একেবারে  কাটতে চায় না।  তার ওপর ট্রেন চড়ার আগ্রহ।  বাবা আর আমি বারে বারেই গিয়ে দেখে আসছি যে ডাউন ট্রেনটা আদৌ এলো কি না ? ওটার ওপর নির্ভর করবে আমরা কখন রওনা দেব।  ট্রেন টি এলো ৮:৩০ নাগাদ।  এখন ফেরত যাবে লিলুয়া পরিষ্কার হতে আর সব ঠিক থাকলে  আমাদের নিয়ে ছাড়বে রাত ১২ টা। সঙ্গে প্রথম রাতের খাওয়ার ছিল তাই ডিনার করে নিলাম ওয়েটিং রুমে বসে।  ১১ টা নাগাদ সব মাল পত্তর নিয়ে নীচে নামলাম ৯ নম্বর প্লাটফর্মের দিকে। তখনো তেমন কোনো ঘোষণা হয়নি যে কখন ট্রেন ছাড়বে। আরো দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করার পর অবশেষে রাট দেড়টা নাগাদ ট্রেন চলতে শুরু করলো।  অর্থাৎ নিধারিত সময়ের থেকে সাড়ে ছয় ঘন্টা দেরিতে। উঠেই বাঙ্কে ঘুমিয়ে পড়লাম।  পরের দিন গোটা দিন ট্রেন জার্নি উপভোগ করলাম।  গয়া, মুঘল সারাই, এলাহাবাদ , কানপুর এবং আবশেষে পুরানো দিল্লি স্টেশন। কিছুটা সময় মেক আপ করেছিল। দিল্লি তে ট্রেনের থামবার কথা ৩ ঘন্টা।  কিন্তু সেই দিন যেহেতু ট্রেন লেট্ যাচ্ছিলো তাই এক ঘণ্টা পরেই ট্রেন কালকার দিকে রওনা দিলো। ফলে আরো ২ ঘন্টা মেক আপ হয়ে গেলো। পরের দিন ঘুম থেকে ওঠার পর ট্রেন পাঞ্জাবে ঢুকে গেছে।  চন্ডিগড়, আম্বালা পেরিয়ে কালকা পৌঁছলো সকাল ১১ নাগাদ। জীবনের এই প্রথম দুই রাতের ট্রেন জার্নি।  আমার ছুটি তো অলরেডি সার্থক হয়ে গেছে।
উত্তর ভারতের শীতের প্রথম স্বাদ পেলাম।  বরাবর ই এই শীত আমার খুব ভালো লাগে।  এটা ছিল সেই শীতের প্রথম অভিজ্ঞতা।  এর পর ক্রমশ ঠান্ডা বাড়তে থাকবে আর কিছুক্ষনের মধ্যে বরফ দেখতে পারবো। সেটা হওয়ার জন্য আর একটা বিচিত্র ট্রেন অভিজ্ঞতা বাকি রয়েছে।  সেটা হলো কালকা থেকে শিমলার বিখ্যাত ন্যারো গেজ ট্রেন যা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের ৭৫০০ ফিট উঁচু শিমলায় নিয়ে যাবে। যেটাতে চড়লাম সেটা অবশ্য ঠিক ট্রেন নয়।  ওকে বলে রেল কার।  অর্থাৎ রেলের ওপর গাড়ি। এই ধরুন যদি একটা বাস কে যদি ট্রেন লাইনের ওপর চালানো হয় তাহলে যেমন হবে।  এটা দেখে আরও ভালো লাগলো আর বোনাস হলো যে ড্রাইভার এর পাশের সিটটা আমি পেয়ে গেলাম। ফলে সুন্দর পাহাড়ি পথের সব চেয়ে ভালো ভিউ দেখতে পাবো।  একই সাথে জীবনের এতো গুলো নতুন অভিজ্ঞতা।  দিনের বেলা প্রায় ছয় ঘন্টার রাস্তা।  পথে ট্রেন বারোগ আর সোলানে থামবার কথা। বেশ ভালো স্পীডে যাচ্ছিলো আর প্রত্যেক ১৫-২০ মিনিটের  মধ্যে পাহাড়ের মধ্যে একটা টানেলে ঢুকে পড়ছে।  যতদূর মনে পড়ছে প্রায় ৮০ টা টানেল আছে গোটা রাস্তায়।  অনেক স্টেশনেই ট্রেন থামছে না।  এই সময় একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম।  স্টেশন পার হওয়ার সময় ড্রাইভার একটা লোহার রিং হাতে নিয়ে জানালার বাইরে ধরে থাকছে আর স্টেশনের একজন কর্মচারি সেই রিং তা নিয়ে আর একটা রিং ড্রাইভারের হাতে গলিয়ে দিচ্ছে।  বাবা পরে বললো এটা অনেক দিনের পুরানো সিস্টেম।  সব ট্রেনেই হয় এবারে একেবারে ড্রাইভারের সঙ্গে বসেছি বলে দেখতে পেলাম। এটা একটা সেফটি প্রটোকল, মানে স্টেশন স্বীকৃতি দিচ্ছে যে ট্রেন তাকে পার করেছে।  যাতে পরে কিছু গোলমাল হলে তার সঠিক তদন্ত হতে পারে।  অর্ধেক পথ গিয়ে বারোগ স্টেশন।  ঠান্ডা আরো কনকনে হতে লাগলো। সকলেরই পরনে আমেরিকা থেকে আনা পার্কা জ্যাকেট।  খুব জমাটে লাগলো এই রকম একটা হিল স্টেশনের ছোট স্টেশনে নেমে। রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করা হলো আর তারপর আবার যাত্রা।  ঠান্ডার মধ্যে হাঠতে খুব ভালো লাগছিলো।  সোলান পেরিয়ে শিমলা পৌঁছলাম প্রায় সন্ধ্যার ঝোকে।এখন ভাবতে আশ্চর্য লাগবে কিন্তু তখন আমাদের কোনো হোটেলে বুকিং করা ছিল না।  তখন এত ভাবা হত্ না।  আজকাল তো দশটা হোটেলের রিভিউ পরে হাজার রকম জিনিস দেখে বেরোবার আগে থেকে বুকিং করে যাওয়া হয়। পরে ২০০৮ সালে যখন আবার গিয়েছিলাম তখন তো বাবা দিন সাতেক আগে থেকেই ওখানকার বড় হোটেল হলিডে হোম এ বুকিং করে দিয়েছিলো।
যাই হোক এই সব ক্ষেত্রে ট্যাক্সি ড্রাইভার রাই ভরসা।  তারা তাদের যা চেনা হোটেল আছে সেখানেই নিয়ে যাবে। সব মাল পত্তর নিয়ে একটা অ্যাম্বাসেডর ট্যাক্সি তে ওঠা হলো আর বলা হলো ম্যাল রোডের কাছে কোনো হোটেলে পৌঁছে দিতে। ইতিমধ্যে একেবারে হাড় কাপানি ঠান্ডা। রাস্তায় বেশ সাদা বরফ যদিও সেই মুহূর্তে স্নো ফল হচ্ছিলো না।  পাহাড়ি জায়গা , রাস্তা খুবই শুরু আর সব রাস্তায় গাড়ি চলতে দেয় না। বেশ কষ্ট করে ট্যাক্সি টা ম্যাল রোডের মুখে আমাদের লাভিনা হোটেলে নিয়ে এলো।  বেশ ভালোই দেখতে হোটেল তাই এতো লম্বা জার্নি করার পর ঘরে বসে হিটার চালিয়ে বেশ আরাম লাগলো। রুম সার্ভিসে ডিনার  হয়ে গেলো।  পর দিন সকালে ওঠা হলো আর ভাবলাম আজ শহর দেখা শুরু।  এদিকে টি ভি তে ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা হচ্ছে করাচিতে।  মনোজ প্রভাকর গোড়াতেই ৩ উইকেট নিয়ে নিলো আর সেই সঙ্গেই পাকিস্তানী দর্শকরা গোলমাল শুরু করে দিলো। মাঠে পাথর ছুড়তে লাগলো আর থামলো না।  ফলে খেলা পরিত্যক্ত হয়ে গেলো। আপসোস করার সময় ছিল না।  ভাবলাম যে যাক এবার নিশ্চিন্তে শহর পরিক্রমা করা যাবে। এই সব ভাবছি তখন আর এক ঝামেলা।  মা আর দিদার হোটেল পছন্দ হলো না।  কি সমস্যা ঠিক বুঝলাম না।  মহিলা দের ব্যাপারে কিছু বোঝার চেষ্টা করার কোনো মানে হয়ে না।  ঠিক হলো হোটেল বদলানো হবে।  তাই  করা হলো। আমরা শিবালিক বলে একটা হোটেলে উঠে গেলাম। সেখানে দুই রাত থাকবার পর সেখানেও কি সব সমস্যা দেখা দিলো। এবার উঠলাম হোটেল ব্রিজ ভিউ তে।  সেখানেও এক রাতের বেশি থাকা হলো না।  অবশেষে উঠলাম ম্যাল রোডের ওপর হোটেল সম্রাটে।  এখানে আর সমস্যা হয়নি তাই বাকি সময়টা পুরোটাই এই হোটেলে থাকলাম।
আমাদের শিমলায় থাকার কথা দশ দিন। এখন ভাবলে অবাক লাগে যে একই জায়গায় এতদিন থাকবো। আজকাল তো ২-৩ দিনের বেশি কোথাও থাকবার সময় নেই আর ভালোও লাগে না।  ছটফটানি শুরু হয়ে যায়।  ২০০৮ সালে যখন আবার আসি শিমলা তখন ছিলাম মাত্র ২ রাত্রী।  তার পর মানালি রওনা দিয়েছিলাম।
ফলে হাতে অনেক সময়  ছিল।  হোটেল বদলানোর চক্করে শহর দেখা বা ছুটির মজা নেওয়া তে  কোনো ব্যাঘাত পড়লো না। উল্টে প্রথম ৪ দিন বেশ মজাই লাগলো।  রুটিন ছিল দুই বেলা ম্যাল রোডে গ্লাভ্স আর মানকি ক্যাপ পরে হাঁটা দেওয়া। ঠান্ডা থেকে আরাম পাওয়ার জন্য বারে বারে কফি খাওয়া।  মাঝে একবার হোটেলে এসে বিশ্রাম। অনেক দোকানে দোকানে ঘোরা।  ২-৩ খানা ক্রিকেটের বই কেনা হলো আর একটা তুপি কেনা হলো যা ক্রিকেটাররা পরে। বরফ পড়তে দেখা এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।  বড়দিন অর্থাৎ ক্রিসমাসের সময়, তাই যাকে বলে ‘ওয়াইট ‘ ক্রিসমাস অনুভব করা গেলো। ক্রিসমাসের দিন আমরা গিয়েছিলাম কুফরী যেটা শিমলা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে আরো মোটা বরফ। বরফের ওপর স্লে তে বসে ঘোরা হলো।  যদিও ঘোড়া নয়, মানুষ দিয়ে টানা।
দশ দিন বেশ ভালো ভাবে কেটে গেলো। যাওয়ার সময় এসে গেলো। এবার ট্রেনে নয় , গাড়িতে করে চন্ডিগড়। একটা আম্বাসাডার  ট্যাক্সি নেওয়া হলো।  ৫ ঘন্টার সুন্দর ড্রাইভ। পাহাড়ের আরো সুন্দর রূপ দেখা গেলো। চন্ডিগড়  পৌঁছে  বেশ আরাম লাগলো।  ওই হাড় কাপানি ঠান্ডা থেকে মুক্তি পাওয়া গেলো। ভাবলাম অনেক হয়েছে। আরোমা হোটেলে উঠলাম। বেশ ভালো হোটেল।  সুন্দর প্ল্যান করা শহর চন্ডিগড়। দেখার মতো ছিল সুন্দর সুখনা লেক এবং রক গার্ডেন। ২ রাত থাকবার পর এবার আমরা গাড়িতে করে দিল্লির দিকে রওনা দিলাম।
স্টেশনের কাছে কারোল বাগে আমাদের চেনা হোটেল কমফোর্ট ইন এ উঠলাম। ভাবলাম এই হলো ট্রিপের শেষ হোটেল। হঠাৎ রাতে ইঁদুরের উপদ্রব হলো। ফলে পরের দিন আবার হোটেল বদল। এম্পায়ার নামের এক হোটেলে উঠলাম এবং এটাই শেষ হোটেল কলকাতা রওনা দেওয়া পর্যন্ত। ইতি মধ্যে বাবা মার্ সাথে ২ দিনের জন্য জয়পুর ঘুরে এলাম।  ওখানে এক দাদু থাকতেন। অবশেষে কলকাতা যাওয়ার সময় এসে গেলো। নতুন বছর পরে গেছে, ছুটি প্রায় শেষ।  ফেরা হলো রাজধানী এক্সপ্রেসে চেয়ার কারে। এক রাতের জার্নি।  সকাল ১১ তা নাগাদ হাওড়া পৌঁছে গেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published.