The Heart Travels

ট্রিনিটি কলেজ – কেম্ব্রিজ

লন্ডন অনেকটা দেখা হয়ে গেছে। তাই এবার পালা লন্ডনের আশে পাশের জায়গা গুলো ঘুরে দেখার। ইংল্যান্ড খুবই সুন্দর দেশ এবং শহরের বাইরে গেলে এক অন্য রুপ দেখা যায় যেটা আরও সুন্দর। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে কেমব্রিজ যাবো। লন্ডন থেকে ১ ঘন্তার দুরত্মে সুন্দর ছোট শহর যেখানে প্রায় ৮০০ বিশ্ব বিদ্যালয় স্থাপিত আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন কোনা থেকে ছাত্ররা  পড়তে আসে এখানকার বিখ্যাত কলেজগুলি তে। যেমন ট্রিনিটি, কিংস ইত্যাদি। ইতিহাশের অনেক নাম করা বিদ্যান লোক এই কেম্ব্রিজ থেকেই পড়াশোনা করে বড় হয়েছে আর নাম কামিয়েছে।
আমার শালী আরশিয়া অনেক বছর ধরে ইংল্যান্ডেই আছে। সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে এবং স্বামী ইশানের সাথে এখন হাল শহরে থাকে। আমি লন্ডনে এসেছি বলে আমার সাথে একটা উইকেন্ড কাটাতে লন্ডন এসেছে । ইশানের কাজ আছে তাই ও আসতে পারেনি। আমার কেমব্রিজ যাওয়ার প্ল্যান আগেই ওকে বলেছিলাম। কেমব্রিজে ওর এক বন্ধু থাকে এবং যায়গাটা ওর ও খুব প্রিয় তাই একবারেই রাজি হয়ে গেল এক সঙ্গে যেতে। এর চেয়ে ভাল সঙ্গি আর কে হতে পারে। ধরেই নিলাম খুব ভাল ট্রিপ হবে।
আমি জানতাম কেম্ব্রিজের ট্রেন ঘণ্টায় ঘণ্টায় ছাড়ে লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশন থেকে। সকালে উঠে দুজনে ব্রেকফাস্ট খেয়ে চলে গেলাম লিভারপুল স্ট্রিট। পৌঁছেই দেখি ৫ মিনিটের মধ্যে ১২:১৫ নাগাদ ট্রেন আছে। টিকিট মেশিনে তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লাম।  ঘড়ীর কাঁটা মিলিয়ে ১২:১৫ নাগাদ ট্রেন কেম্ব্রিজের দিকে চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধেই জানালা দিয়ে দেখা গেল সুন্দর ব্রিটিশ কান্ট্রিসাইড। শীতকাল, অথছ বরফ একেবারেই নেই আর গাছের শবুজ রঙটা একটু ফ্যাকাশে হলেও খুবই সুন্দর লাগছিলো। আমরা আন্দাজ করেছিলাম ট্রেনে ১ ঘন্টা লাগবে। সেই হিসেবে পৌছনোর কথা ১:১৫। কিন্তু আমরা বুঝলাম যে ট্রেন খুবই আস্তে যাচ্ছে এবং প্রত্যেক স্টেশনে থামছে। ঘড়িতে দেখি ১:১৫ বাজে অথচ ফোনের জি পি এস বলছে এখনও এনেকটা পথ বাকি। চিন্তায় পড়ে গেলাম একটু। এখন খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যায় তাই দিনের বেলা শহর দেখার আর ক্যাম নদীতে পানটিং করার সময় বিকেল ৫ টা পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রায় ৩ ঘণ্টা মাত্র। পরে জানলাম আমরা উঠেছি স্লো ট্রেনে। কিংস ক্রস থেকে নন স্টপ ট্রেন ছাড়ে কেম্ব্রিজের জন্য। যাই হোক, এখন সেটা ভেবে আর লাভ নেই। দুটো নাগাদ পৌঁছে গেলাম। আবহাওয়া খুব ভাল ছিল। রোদ্দুর উঠে আছে কিন্তু খুবই ঠাণ্ডা। বেশ কনকনে হাওয়া দিচ্ছিল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা একটা ডবল ডেকার বাসে উঠলাম সিটি সেন্টার যাওয়ার জন্য। এখানকার বাস গুলো নীল রঙের। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সিটি সেন্তার। নেমেই একটা আন্দাজ হয়ে গেল যায়গাটা কেমন হবে। লন্ডনের বিশাল উঁচু নতুন নতুন বাড়ি দেখবার পর এখানে এসে মনটা একেবারে অনেক বছর পিছিয়ে গেল। চারপাশে সব ঐতিহাসিক হেরিটেজ বাড়ি আর পাথরের রাস্তা। যে রাস্তা প্রধানত তৈরি হয়েছে ঘোড়া চলাচলের জন্য। আমি প্রাগ শহরে ২ বছর ছিলাম। এখানে এসে ঠিক প্রাগের কথা মনে পড়ে গেল। শুধু প্রাগ কেন,  যে কোন পুরানো উইরোপিয়ান শহরের টাউন সেন্টার ঠিক এই রকম লাগে। সব জেনে নিতে একটু সময় লাগলো। জানলাম যে ক্যাম নদীতে জোর কারেন্টের ফলে আনেক যায়গায় পানটিং বন্ধ। এক পুলিশ কে জিজ্ঞাশা করে এক দিকে হাঁঠতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি একটা সুন্দর ক্যাম্পাস আর তার বাইরে বড় বড় করে লেখা ট্রিনিটি কলেজ। বুঝলাম যে ঠিক দিকেই এসেছি। কেমব্রিজের অন্যতম শ্রেষ্ট বিশ্ব বিদ্যালয় এই ট্রিনিটি কলেজ। অনেক নাম শুনেছি এই কলেজের তাই এক পাউন্ডের টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। মন একেবারে ভরে গেল। সুন্দর পুরানো আমলের হেরিটেজ আর্কিটেকচার আর মাঝখানে সুন্দর সবুজ লন। অনেক ছবি তোলা হলো দুজনের। এতক্ষণে সূর্য দেব মেঘের আড়ালে চলে গেছেন তাই আরো শীত করতে লাগলো। আবার হাঠতে লাগলাম অলি গলি দিয়ে। কিছু দূর গিয়ে দেখলাম একটা দল পান্তিং এর জন্য লোক ডাকছে। বলল এই শেষ ব্যাচ এবং শুরু হবে ৪ ৩০ নাগাদ। এখন বাজে ৩ টে তাই আমাদের হাতে অনেক সময় আছে। খিদে পেয়ে গেছে তাই একটা খাবারের জায়গা খুজতে লাগলাম। বেশি না ঘুরে এক ফরাসী বেকারী তে ঢুকে পড়লাম। এতক্ষণে দুজনে শীতে প্রায় কুলফির মত জমে গেছি। সুতরাং প্রথমেই হট চকলেট খেলাম আর কিছু ক্রৈসন্ট সঙ্গে নিয়ে নিলাম। দেখতে দেখতে সাড়ে চারটে বেজে গেল এবং আমরা পানটিং দলের সাথে নদীর দিকে চললাম। একটা নৌকাতে প্রায় দশ জন ধরে যায়। সঙ্গে এক জন পান্টার অর্থাৎ যে দাড় সামলাবে। নদী গভীর একেবারেই নয়। এটাকে একটা ক্যানাল বা নালা বলা যেতে পারে। পানটিং হল দাঁড়কে নদীর মাটিতে ঠেলে নৌকা কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এতক্ষণে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল যা এই দেশে খুবই স্বভাভিক। নৌকায় চলতে চলতে দেখলাম বিখ্যাত কিংস কলেজ এবং তারই কিছু এগিয়ে কুইন্স কলেজ। আরো অনেক কলেজ দেখলাম যার নাম আমাদের পানটার বলে যাচ্ছিলো। কারেন্ট খুব জোর ছিলো তাই আর স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়া গেলো না। এবার নদীর স্রোতের সঙ্গে আমরা বইতে লাগলাম। কিছু দূর গিয়ে নেমে পড়লাম যাতে ফেরার জন্য বেশি চলতে না হয়। এবার ঠিক হল একটু মার্কেটের দিকে যাবো। মার্কেটে আরশিয়ার বন্ধু শিভি আমাদের সঙ্গে দেখা করল। কিছু কেনা কাটা করে আমরা একটা ইংলিশ পাব এ খেতে গেলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শীত এত বেড়ে গেছে যে আর বাইরে থাকা যাচ্ছে না। তাই পাব এ খুব আরাম লাগছিলো। আরাম করে আমার প্রিয় ফিশ অ্যান্ড চিপস খেলাম। এবার দেখলাম বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাই স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। শিভি সাইকেলে করে এসেছিলো। আমাদের এত শীত করছিল যে আর বাসের অপেক্ষা করতে পারলাম না। সোজা ট্যাক্সি ধরে স্টেশন চলে গেলাম। সকালে যে ভুলটা করেছিলাম সেটা আর করলাম না। এবার কিংস ক্রসের নন স্টপ ট্রেনে চড়লাম। এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। ট্রেনে একটু ঘুম ও হয়ে গেলো।

লন্ডনে নেমে দেখলাম সবে রাত ৯ টা। এখনও অনেক সময় আছে ঘোরার। গেলাম লেসটার স্কয়ারের কাছে চাইনা টাউনে। চিনে নতুন বছর পড়েছে ২ দিন আগে তাই পুরো জায়গাটা সাজানো হয়েছে। আমরা একটা চিনে রেস্তুরান্তে দিনার করলাম আর তারপর পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখলাম। অবশেষে পিকাদিলি সার্কাস স্টেশন থেকে টিউব ধরে বাড়ি ফিরলাম প্রায় রাত ১ টা।
পরদিন রবিবার। আরশিয়ার ট্রেন কিংস ক্রস থেকে ছাড়ল দুপুর দুটো নাগাদ। ওকে সি অফ করার পর পুরো বিকেলটা আমার খালি। ঠিক করলাম দেখতে যাবো, লন্ডনের সব চেয়ে বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক এবং বলা যেতে পারে এক রকম লন্ডনের প্রাতিক, টাওয়ার ব্রিজ। এই ব্রিজ সবার পরিচিত। লন্ডনের যে কোন টুরিস্ম সঙ্ক্রান্ত ছবি বা গাইদবুকে সব চেয়ে প্রথম যার ছবি দেখা যায় তা হল এই টাওয়ার ব্রিজের। টাওয়ার হিল স্টেশনে নেমে দেখলাম উলটো দিকে টাওয়ার অফ লন্ডন যেখানে শুনেছি কোহিনুর হিরে রাখা আছে। ওখানে যাওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিল না তাই সময় নষ্ট না করে সোজা চলে গেলাম ব্রিজে। দুটো বিশাল টাওয়ারের ওপর ভর করে দাঁড়ীয়ে আছে এই টাওয়ার ব্রিজ। ব্রিজটা যাতে ভালো করে দেখা যায় তাই নেমে সাউথ ব্যাঙ্কে হাঠতে লাগলাম।

টাওয়ার ব্রিজ
একটু যেতেই ঘুরে যখন তাকালাম তখন দেখে মনে হলো যেন পোস্ট কার্ড দেখছি। অস্তগামি সূর্যের আলোয় ব্রিজটা একটা সোনালি রুপ ধারন করেছে। অনেক ছবি তুললাম আর দু-এক জন অচেনা লোককে বললাম আমার ছবি তুলে দিতে। আবার ফিরে গেলাম ব্রিজে। সময় অনেক ছিল তাই ভাবলাম টিকিট কেটে টাওয়ারের ওপর যাই। ৮ পাউন্ড দিয়ে টিকিট কেটে লিফটে করে ওপরে গেলাম। ওপর থেকে ভালো ভিউ পাওয়া যায় আর একটা মিউজিয়াম আছে। একটা টুর হয় যেখানে ব্রিজটার ইতিহাশ আর ব্যাবহার সম্বন্ধে বলে। সবাই যানে যে জাহাজ চলাচলের সময় ব্রিজটা গুটিয়ে যায়। সেটা কি ভাবে এবং মাসে কতবার হয় সেটা একটা স্ক্রিনে দেখিয়ে বোঝাচ্ছিল। খুব একটা ভালো লাগলো না তাই তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলাম। এতক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে আর ব্রিজে আলো জ্বলে গেছে। আবার সেই এক ছবি তোলার যায়গায় গেলাম এবং ব্রিজের আর এক সুন্দর রুপ দেখলাম। সন্ধ্যের কালো আকাশে ঝলমল করছে টাওয়ার ব্রিজ। আর একটা পোস্ট কার্ড।

ঘড়িতে দেখলাম প্রায় ৭ টা বেজে গেছে তাই ভাবলাম আজ এইখানেই ইতি দেবো। একটু বাজার করে ঘরে ফিরে এসে পরের দিনের অফিসের কিছু কাজ করে নিলাম।

1 Comment

  1. avatar

    khoob bhalo hoyeche

Leave a Reply

Your email address will not be published.