|
ট্রাফালগার স্কোয়ার |
নতুন শহর বা দেশ দেখতে বরাবর আমার খুব ভালো লাগে। চাকরী ও তাও এমন, যেখানে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়। এই আই টি কোম্পানির চাকরীর দৌলতে অনেক দেশ এবং শহর ঘোরার অভিজ্ঞতা হয়েছে। মেল্বর্ন, মস্কো, প্রাগ, ম্যানিলার মতো জায়গায় থাকার এবং কাজ করার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু যদি কোনো সপ্ণের শহর হয় যেখানে সব সময় যাওয়ার এবং থাকার একটা ইচ্ছা ছিল সেই শহর হলো নিঃসন্দেহে লন্ডন। প্রাগে থাকতে কয়েকবার লন্ডন আসার সুযোগ হয়েছিল কিন্তু সে সব তো খালি উইকেন্ড-এর জন্য। তাতে আর কত দেখা বা বোঝা যায়। এবার লন্ডনে এক মাসের জন্য একটা কাজ পড়লো। প্রথমে ভাবতেই আশ্চর্য লাগছিল যে অবশেষে লন্ডন কে পুরোপুরি দেখার সুযোগ পাবো। শুধু লন্ডন কেন, আসে পাশে ইংল্যান্ডের নানা জায়গা দেখার সুযোগ হবে।
যাওয়ার সময় এসে গেলো ১৫ই জানুয়ারী। কোম্পানি থেকে টিকিট বুক করা হল পুনে থেকে দিল্লী আর সেখান থেকে লন্ডন। পুনে থেকে প্লেনএ চড়ে সোজা ল্যান্ড করলাম দিল্লী এরপোর্ট-এর টর্মিনল ৩ এ। সময় খুবই কম ছিল হাতে তাই অত সুন্দর এরপোর্টটা ভালো করে দেখা গেলো না। ইম্মিগ্রেশন করে বোর্ডিং গেট পৌঁছতে পৌঁছতে সমই একেবারে ফুরিয়ে গেলো তাই আর সময় নষ্ট না করে সোজা ঐইরোব্রিজ দিয়ে উঠে পড়লাম এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িংগ ৭৭৭ বিমানে। নয় ঘন্টার টানা ফ্লাইট তাই ভাবলাম ডিব্বী আরাম করে খেয়ে, ঘুমিয়ে আর সিনেমা দেখে কেটে যাবে। ঠিক তাই হল। যদিও অনেক লোকের এয়ার ইন্ডিয়া সমবন্ধে ভাল মতামত নয়, আমার খুবই ভালো লাগে। বিশেষ করে ওদের খাওয়া। তাছাড়া সিনেমার অনেক চয়েস ছিল আর স্ন্যাক্সও খুব ভাল দিয়েছিল।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬:৪০ নাগাদ আমরা ল্যান্ড করলাম লন্ডনের হিথরো এরপোর্টএর ৪ নম্বর টার্মিনালে। নেমেই বোঝা গেলো কেন লন্ডন পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় এবং জমজমাট শহর। আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলাম যে ইম্মিগ্রেশনএ অনেক ভীড় হবে আর সময় লাগবে। একেবারে তাই হলো। বেরোতে বেরোতে প্রায় ৯টা বেজে গেলো। ট্যাক্সি করে সোজা চলে গেলাম কোম্পানির বুক করা সার্বিস অপার্টমেনটে।
শনিবার আসতেই সেন্ট্রাল লন্ডন যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। আগে এসেছি তাই মোটামুটি জানতাম কোন যাইগা গুলোতে যেতে হবে আর এখানকার টিউবটার ব্যাপারেও ভাল আন্দাজ ছিল। স্মার্ট ফোনএ একটা ম্যাপ ডাউন লোড করে নিলাম আর ব্যাস লন্ডন দেখার জন্য প্রস্তুত।
আমার থাকবার জায়গার কাছে আছে ল্যাংডন পার্ক ডি এল আর ট্রেন স্টেশন। এটা ঠিক টিউব নয় তবে একটা ছোট ট্রেন যা অল্প দুরত্বের জায়গা গুলো কানেক্ট করে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে গেলাম কানারি ওআর্ফ। সেখান থেকে জুবিলি লাইন ধরে সোজা চলে গেলাম ওয়াটার্লু। ওখানে টেম নদীর ধারে সাউথ ব্যাংক খুব জনপ্রিয় জায়গা। ওখানে আছে বিখ্যাত লন্ডন আই – একটা বিশাল জায়ান্ট হুইল যার ওপর চড়ে পুরো লন্ডন দেখা যায়। টিকিটের অনেক লম্বা লাইন দেখে ভাবলাম পরে এক দিন আশা যাবে। হাটতে হাটতে চলে গেলাম ওয়েস্টমিন্সটার এর দিকে। সেখানে দেখলাম পার্লামেন্ট এবং বিগ বেন। আরও কিছুখন থেকে এবার রওনা দিলাম অক্সফোর্ড সার্কাস এর দিকে। এই জায়গা হল সত্যিকারের ব্যাস্ত লন্ডন। লালমোহনবাবু দেখে বলেছিলেন “ওশন অফ হ্যুমানিটি”। একেবারে ঠিক কথা। সেই জনসমুদ্র দেখতে দেখতেই পুরো সময় কেটে যায়। এই রকম জায়গায় এসে শহরটাকে ভালো ভাবে চেনা যায়। ভর্তি দোকান আর অনেক টুরিস্টদের ভীড়। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত হাটা দিলাম আর কিছু খেয়ে নিলাম। তার পর সন্ধের ঝোকে যখন শীত করতে শুরু করল তখন রাস্তার সবচেয়ে বড় আর নাম করা দোকান সেলফ্রিজেস এ গিয়ে আশ্রয় নিলাম এবং লালমোহন বাবুর মতনই একটা মাঝারি দামের ফাওন্টেন পেন কিনলাম। এর পর হেঁটে গেলাম আর এক জনপ্রিয় জায়গায় – পিকাদিলি সার্কাস। সেই জায়গা অক্সফোর্ড এর থেকেও বেশি জমজমাট আর আলোয় ঝলমল করছে। তার পাশেই আরও জমাটে লেস্টার স্কোয়ার। পুরো জায়গায় মানুষের ভীড় আর তার মধ্যে দিয়ে চলেছে লাল ডবল দেকার বাস আর চারিদিকে প্রচুর রেস্তুরান্তে বসে সবাই হয় খাচ্ছে বা গল্পে মেতে আছে। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য। লেস্টার স্কোয়ার থেকে আরো কিছু দূর গেলেই আছে বিখ্যাত ট্রাফালগার স্কোয়ার কিন্তু ইতিমধ্যে আমার এক বন্ধু সত্যপ্রকাশ এর সাথে দেখা করার কথা তাই আবার বেরিয়ে পড়লাম টিউবে করে পিকাদিলি স্টেশন থেকে। পিকাদিলি লাইন ধরে গেলাম উসটনে। সেখান থেকে দুরের ট্রেন চলাচল করে। সত্যপ্রকাশ আসছিল ক্রানফিল্ড থেকে। সত্য আর আমি এক সঙ্গে প্রাগ এ কাজ করতাম। ও এখন চাকরী ছেড়ে দিয়ে ক্রানফিল্ডে এম বি এ পড়ছে। অনেক দিন পরে দেখা হচ্ছে তাই ভালই লাগছিল। ক্রিকেট আর হিন্দী ছবি নিয়ে আমাদের অনেক আড্ডা হয়। ওর সঙ্গে দেখা করে আমরা দুজনে হাঁটা দিলাম কোভেন্ট গার্ডেনের দিকে। যদিও টিউবে যাওয়া যেত কিন্তু জেহেতু শীত একটু কম ছিল তাই ঠিক করলাম হেঁটেই যাব। তাছারা হেঁটে গেলে শহরটাকেও ভালো ভাবে দেখা এবং জানা যায়। কোভেন্ট গার্ডেনে অনেক খাওয়ার জায়গা। তাই ঠিক হলো ওখানেই সময় কাটানো হবে। পরদিনের প্ল্যান হল ট্রাফালগার স্কোয়ার ঘোরার।
|
পিকাদিলি সার্কাস |
পরদিন রোববার। ঘরে ব্রেকফাস্ট করে বেরোতে বেরোতে হয়ে গেল প্রায় দুপুর ১টা। আবার জুবিলি লাইন ধরে গেলাম ওয়াটার্লু। সেখান থেকে বেকার্লু লাইন নিয়ে চলে গেলাম চারিং ক্রস। ওইখানেই ট্রাফালগার স্কোয়ার। জায়গাটা বিখ্যত অনেক কারনে। তার মধ্যে একটা হলো ওখানে অনেক পায়রা এসে জমা হয়। আগে লোকে এসে এই সব পায়রাদের দানা ছুড়ে খাওয়াতো, যে দৃশ্যটি দেখানো হয়েছে বিখ্যাত হিন্দী ছবি ‘দিলওয়ালে দুল্হনিয়া লে জায়েঙ্গে’ তে। এখন আর সেটা করার অনুমতি নেই কারণ এর ফলে জায়গাটা অত্যন্ত নোংরা হয়ে যায়। একটা বোর্ড লাগানো আছে যেখানে ৫টি ভাষায় লেখা যে “দয়া করে পায়রাদের খাওয়াবেন না”। আমরা ওখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে ছবি-টবি তুলে এক ভারতীয় রেসতুরান্তে গিয়ে লাঞ্চ খেলাম। শীতকাল, তাই খাওয়া শেষ করে যখন বেরোলাম তখন দেখি প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। পরদিন আবার কাজের দিন। সত্য কে ক্রানফিল্ড ফেরত যেতে হবে। তাই ঠিক হল আজকের মত ঘোরা এইখানেই শেষ। ফেরার পথে লন্ডন ব্রিজের কাছে আরেক বন্ধুর সাথে দেখা করে সেই জুবিলি লাইন ধরে ঘরে ফিরে গেলাম।